আহাম্মক
সে শুয়েছিল। অগোছালো একটা বিছানায়। ঘুমন্ত। স্বপ্নে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল একদল মানুষ। রোজ এই একই স্বপ্ন দেখে সে। আর রোজই মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। সেই একদল মানুষের প্রচণ্ড চিৎকারের রেশ তাকে ঘিরে থাকে ঘুম ভেঙে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সে বিছানায় উঠে বসে। তার সারা শরীর বেয়ে বয়ে যায় ভয়ের ঠান্ডা স্রোত। ঘামে ভিজে যায় তার গোটা শরীর। এমনকী এই প্রচণ্ড শীতেও। যে চাদর সে গায়ে দিয়ে ছিল, তা দিয়েই সে মুছে নেয় ঘাম। তারপর শুয়ে পড়ে। আবার চেষ্টা করে ঘুমোনোর। ঘুম আসে। এলেও সেই একই স্বপ্ন আবার তাকে তাড়া করে।
২
সকাল হয়। তার ঘুম ভাঙে। সে জানে রোদঝলমলে এই নতুন সকাল তাকে কিছুই দেবে না। ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে চেনা যে পৃথিবী, তা তাকে উপহার দেবে শুধুই লাঞ্ছনা আর কটূক্তি। কারণ সে ভীতু। এতটাই ভীতু যে, নিজের ছায়াকে দেখেও কখনো কখনো ভয়ে সে চমকে ওঠে। সে যখন হাঁটে, তখন তার চোখের মণিদুটো সবসময়ই কোনো অজানা বিপদের সঙ্কেত পেয়ে দ্রুতবেগে ঘুরতে থাকে। এদিক-ওদিক। তাই দেখে তার আশপাশের লোকজনেরা তার দিকে ছুড়ে দেয় কখনো চাপা হাসি, কখনো টিটকিরি কখনো-বা খিস্তি। তখন তার মনে হয় তার শরীরটা যেন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। এমনকী, তার যেন কোনও শরীরই নেই। অথবা, সে নিজেই নেই।
যে এলাকাতেই সে যাক-না কেন, এই চাপা হাসি, টিটকিরি আর খিস্তি তার পিছু ছাড়ে না। এই ছিল তার জীবন। সে ধরে নিয়েছিল এটাই তার ভবিতব্য। সে না ছিল সুখী, না অসুখী। সে শুধু জানত যে, সে ভীতু, সে কাপুরুষ আর—লোকে তাকে যা বলে ডাকে—আহাম্মক।
৩
আজ সকাল থেকে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি একবারও। সে ঠিক করল, আজ সে কাজে বেরোবে না। চায়ে পাউরুটি ডুবিয়ে খেতে খেতে এই ভেবে সে খুশি হল যে, আজ তাকে কারুর মুখ দেখতে হবে না। তার হঠাৎ ইচ্ছে হল, সে তার নোংরা অগোছালো ঘরটাকে আজ একটু পরিষ্কার করবে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আবিষ্কার করল, তার কোনো অতিরিক্ত বিছানার চাদর নেই। অথচ, তার ভীষণভাবে মনে হচ্ছিল, একটা পরিষ্কার বিছানায় ধবধবে সাদা পরিষ্কার চাদর গায়ে দিয়ে যদি সে আজ দুপুরে ঘুমোয়, তাহলে আর কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করবে না।
আজ তার ভালো লাগছিল । তার ভালো লাগছিল সলার ঝাঁটা দিয়ে তার একমাত্র বিছানার চাদরের ময়লাগুলো ঝেড়ে ফেলতে। তার ভালো লাগছিল তার একচিলতে ঘরের জমে থাকা ধুলো বহুদিন পরে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করতে। তার ভালো লাগছিল প্রচণ্ড শীতেও শ্যাওলাধরা চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে স্নান করতে। তার ভালো লাগছিল নিজের হাতে রান্না করা গলা ভাত গোগ্রাসে গিলতে। তার ভালো লাগছিল বিছানায় বহুদিনের বুভুক্ষু শরীরটাকে আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলতে।
৪
কুয়াশামাখা নির্জন দুপুরে প্রচণ্ড ঘুমে জড়িয়ে এল তার দু-চোখ। সে ঘুমিয়ে পড়ল। অবধারিতভাবেই স্বপ্নে আবার সেই একদল লোক তাকে ঘিরে ধরল। তাদের চাপা হাসি, টিটকিরি আর খিস্তি আবার তার শরীরটাকে কুঁকড়ে ছোটো করে দিতে থাকল। প্রচণ্ড ভয়ে তার ঘুম ভেঙে গেল। মন খারাপ হয়ে গেল। সে ভেবেছিল অন্তত আজ এই দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করবে না। কিন্তু না। ভবি ভুলবার নয়।
হঠাৎ খুট করে কোথাও একটা শব্দ হল।
সে ভয় পেয়ে গেল। ভয়টা বাড়তে লাগল যখন সে বুঝতে পারল শব্দটার উৎস তার ঘরেই।
শব্দটা হয়েই চলল। তার চোখ এ মুহূর্তে দ্রুতবেগে ঘুরছে এদিক-ওদিক। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। সে ভাবল, তবে কি আজকেই মরে যাবে সে? হাঁটুদুটো বুকের মধ্যে গুঁজে কুঁজো হয়ে ঠায় সে বসে রইল বিছানার ওপর।
খুট খুট খুট!
শব্দটা হয়েই চলেছে। আর এবার সে শব্দের উৎস ঠিক তার পেছনে। ভয়ে সে ঘাড় ঘোরাতে পারল না। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলে দিল শব্দের উৎস পেছন থেকে এবার তার সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।
ভয়ে কাঠ হয়ে চোখ বুজে সে বসে রইল বিছানার ওপর।
মিউ!
চোখ খুলে অবাক হয়ে সে দেখতে পেল, তার সামনে একটা ছোট্ট সাদা বিড়ালছানা। ঠান্ডায় আর খিদেতে কুঁকড়ে গেছে। দেওয়ালের ভাঙা আয়নায় নিজের ভীতু মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে জীবনে এই প্রথম তার হাসি পেয়ে গেল। হা হা করে প্রচণ্ড জোরে সে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই বিড়ালছানাটাকে বিছানায় তুলে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল। তারপর আরও একবার তাকাল ভাঙা আয়নাটার দিকে। ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠতে লাগল তার মুখ।